আমার দেখা গারো কৃষি কথা

আমি একজন গারো আদিবাসী এবং আমার জন্ম কৃষক পরিবারে । জন্মের পর থেকেই কৃষক পরিবারে জন্ম নেয়ার কারণে কৃষিকাজ কিভাবে করা হতো, কারা করতো, কি কি করা হতো এসকল কাজের সাথে আমার খুব চেনা জানা রয়েছে । দেখেছি, করেছি এবং এনজয় করেছি তাও বলা যেতে পারে কারন কৃষি জমিতে গিয়ে নানা ধরনের খেলাইও মেতেছিলাম আমার বাল্যকাল এবং কৈশোর কাল এমনকি পূর্ণবয়সেও ।
বর্তমানে কিছুদিন ধরে এই কৃষকদের ধান কাটা, ধান সংগ্রহ, শ্রমিক মজুরী ও ধানের মূল্য এসব নিয়ে নানা সমস্যা, জটিল পরিস্থিতি এবং কৃষকদের ভিষনরকম সমস্যাগুলোর নিউজ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ভাইরাল এবং টিভি, মিডিয়া সবখানে কৃষকদের দুরাবস্থার কথা , সমস্যা দেখতে দেখতে আমাদের সময়ে, আমাদের গারো সমাজে কৃষি কাজের নানান বৈচিত্র অভিজ্ঞতা, আনন্দ, স্মৃতি ভিষণভাবে মনে আনাগুনা করছে । এখনকার সময়ের মানে ডিজিটাল যুগের কৃষকদের এত দুরাবস্থার কথা চিন্তা করতে গিয়ে মূলত গারো সমাজের কৃষিকাজের কথা ভিষনভাবে মানে করিয়ে দিচ্ছে, সেই সময়ের মত যদি কৃষি কাজ করা হতো তাহলে এসব কোন সমস্যাই সমস্যা হওয়ার কথা না ।
দশে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ--- একতাই বল, একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করলে কোন কাজই কঠিন এবং সমস্যা বলে মনে হয়না এ কথা আজ থেকে ১৫/২০ বছর আগেও গারো সমাজের মানুষজন মনে প্রানে বিশ্বাস করতো এবং সেভাবেই কাজ করতো । এখনো বিশ্বাস নেই তা বলা যাবেনা তবে আগেকার মত এত সুন্দর, নিষ্ঠা, আন্তরিকতা এবং নিঃস্বার্থভাবে একতাবদ্ধ হয়ে কাউকে সাহায্য করার যে প্রচলন তা অনেকখানিই কমে গেছে এবং তা সবাই স্বীকার করবে আমার মত।
বর্তমান সময়ের কৃষি ও ধান এর কমমূল্য সমস্যা নিয়ে ভয়ংকর রকম জটিলতা বা সংকটকালীন সময়ে গারোদের কৃষি করার প্রচলিত যে ব্যবস্থা সেটি চলমান থাকলিএত সমস্যা হয়তো থাকতো না বা অনেকটাই হ্রাস পেতো । কিভাবে সেটি আমি সংক্ষেপে লেখার চেষ্টা করছি ।

দল বেঁধে জমি চাষ
আমি দেখেছি- যখন ধানে রোপন করার সময় হতো তখন তো জমি চাষ দকরতে হয় । কারো বাড়ীতে এক জোরা হালের গরু থাকতো কারো বাড়ীতে দুই জোরা আবার কারো কারো বাড়ীতে তিন জোরা হালের গরু থাকতো । তখনকার সময়ে আমাদের এলাকায় মানে নেত্রকোনা, কলমাকান্দা এর নাজিরপুরে জমি চাষের জন্য কোন পাওয়ার টিলার ছিলনা আমরা কললাঙ্গল বলতাম । শুধুমাত্র গরু দিয়েই জমি চাষ করতে হতো । যার জমি যত বেশ তাদের কাছে তত জোরা জমি চাষের গরু থাকতো । তখন জমি চাষ করার জন্য কোন কামলা বা শ্রমিক লাগতো, বা থাকলেও খুব কম । আমার অভিজ্ঞতায় জমি চাষের জন্য কেউ টাকা দিয়ে করতে হয়েছে এমন দেখিনি । অনেক জমি হলে গ্রামের সবাই একসাথে, ১৫ জোরা, ২০ জোরা বা পঁচিশ জোরা গরু দিয়ে একসাথে হাল চাষ করা হতো, কোন টাকা দিতে হতো না । সকাল থেকে ১১টা পযর্ন্ত হয়তো করতো তাপপর রাতে সবাই একসাথে মিলেমিশে উঠোনে বসে কলা পাতায় জমির মালিক যা দিয়ে খাবার দিতো তাই হাসি আনন্দে সবাই একসাথে খেতো এবং রাতে ভাত দিয়ে বানানো চু-(রাইস জুস) খেতে দিতো-তাও উঠোনে বসে সবাই খেতো এই ছিল জমি চাষের মজুরি, কোন টাকা গুনতে হতোনা জমির পরিমান অনুযায়ী কোন কৃষকের এখনকার মতো।

জমিতে ধান রোপন
আমি আরো দেখেছি, যখন কারো ধান রোপন করা হতো তখন কোন কামলা বা শ্রমিক নিতোনা । গ্রামের সবাই একসাথে, পুরুষ মহিলা, যুবক যুবতী, বালক বালিকা সবাই একসাথে হয়ে সারাদিন ধান রোপন করে দিতো । ছুটির দিন হলে ছাত্র ছাত্রীরা সবাই জমিতে ধান রোপনের জন্য দলে দলে উপস্থিত হতো । কে ধনী, কে গরীব বা কে বড় কোন ভেদাভেদ ছিলোনা । বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে জমিতে একসাথে ধান রোপন করে দিতো, নিজের ইচ্ছায়, কাউকে জোর করে আনা হতোনা । ১০০/১৫০ এমনকি ২০০ জনও হয়ে যেতো । হিসাব করে দেখেন ২০০ জন যদি এক ঘন্টা ধান রোপন করে তখন কত জমিতে ধার রোপন করতে পারতো ।

কাঁদায় হাস খেলা
আনন্দ , খেলা সব চলতো, হাস খেলা, দৌড়, প্রতিযোগিতা, কাঁদা মাঁখমাঁখি সব চলতো ধার রোপন করতে গিয়ে, অনেকে এই খেলার লোভেই ধার রোপন করতে যেতো । আমি নিজেও অনেক খেলেছি, ধান রোপন করেছি এবং আনন্দ নিয়েই এ কাজগুলো করেছি । পারিশ্রমিক বলতে রাতে একবেলা খাবার সবাই একসাথে । জমির মালিক আনন্দসহকারে যা আপ্যায়ন করে তাই । কারো কোন দাবী থাকতোনা । অনেক বেশী মানুষ উপস্থিত হলে ১ টার মধ্যেই ৭/৮ জন মহিলা যারা রান্না করতে পারদর্শী তারা রান্নার জন্য চলে যেতো কারন ২০০ জন মানুষের রান্নার জন্যতো সময় লাগবেই এখানেও কোন টাকা পয়সা দেয়া হতোনা সবই বিনাপারিশ্রমিকে সহযোগিতা মাত্র ।

ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা একসাথে একই পাতায় কয়েকজন মিলেই আনন্দসহকারে ভাত খেতো খুব মজা করে । কত সুন্দর ছিল সেই দিনগুলি এখন শুধু গল্প ও স্মৃতি এবং ইতিহাস মাত্র যেন ।
জমি চাষ ও ধান রোপনের মতই ধান কাটা , মাড়াই, ধান উড়ানো সব কিছুই প্রতিবেশীর সহায়তা নিয়েই সবকিছু সম্পাদন করা হতো । অন্যান্যদের কথা আমি বলছিনা, আমি আমার দেখা গারো জনগোষ্ঠীর কৃষিকাজ নিয়েই তুলে ধরেছি । সব কাজই স্বেচ্ছাই, নিঝের ইচ্ছামত করে দেয়া হতো । কাউকে জোর করে এসব কাজ করে দিতে হবে এমন কোন দাবী ছিলনা । এসব দলে দলে করার কারনে নিঝেদের মধ্যেও একটা ভাল সম্পর্ক ছিল, কারো বিপদ আপদ হলে সবাই একসাথে ঝাপিয়ে পরতো, সাহায্য করতো । যেমন বিয়ে, মৃত্যু, স্রাধ্য বা সামাজিক কোন অনুষ্ঠান কারো পরিবারে থাকলে চাল, ডাল মাংস , তেল, লবন, খড়ি, পান সুপারি, পিয়াজ, মরিচ সব পাড়া প্রতিবেশী নিয়ে আসতো । অনুষ্ঠঅন শেষ করার পরও এস থেকে যেতো যা আবার অন্যদের সবাইকে বিতরন করা হতো । কত সুন্দর ব্যবস্থা, এখন এগুলো কিছু কিছু থাকলে অনেক কমে গেছে গারোদের মধ্যেও ।
আগেকার মত যদি এমন সহযোগিতা, কাজ করে দেয়ার মানসিকতা এবং এ রীতি প্রচলন থাকতো
তাহলে আমার কাছে মনে হয় কাজ করার জন্য লোকের অভাব হতোনা । অনেক টাকা দিয়েও এখন কাজ করার মানুষ পাওয়া যায়না অনেকের কথা । কত নিউজ দেখি, ছাত্ররা বিনা পারিশ্রমিকে ধান কেটে দিয়েছে, অমুক কলেজের ছাত্র ছাত্রীরা ধান কেটে দিয়েছে, তমুক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীরা কৃষকের ধান কেটে দিয়েছে --কত সুন্দর সুন্দর খবর কাগজে মিডিয়ায় বিভিন্ন মাধ্যমে-----------
সবশেষে বলতে চাই, গারো সমাজের এই রীতি, প্রচলন , প্রথা আবার ফিরে আসুক সেটা বলিনা কিন্তু মানুষের অন্তরে অন্যকে সাহায্য সহযোগিতার মনোভাব জাগ্রত হোক এবং কৃষকদের সুদিক ফিরে আসুক এ কামনা করি ।

মন্তব্যসমূহ

আলোছায়া কথামালা

গারোদের উৎপত্তি, সমাজ ব্যবস্থা, কৃষ্টি-সংস্কৃতি, বিবাহ প্রথা ও মাতৃসূত্রীয় প্রথা

গারো শব্দের উৎপত্তি ও বিভিন্ন মতবাদ (গারোদের উৎপত্তি, সমাজ ব্যবস্থা, কৃষ্টি-সংস্কৃতি, বিবাহ প্রথা ও মাতৃসূত্রীয় প্রথা -১ম পর্ব)