গারো শব্দের উৎপত্তি ও বিভিন্ন মতবাদ (গারোদের উৎপত্তি, সমাজ ব্যবস্থা, কৃষ্টি-সংস্কৃতি, বিবাহ প্রথা ও মাতৃসূত্রীয় প্রথা -১ম পর্ব)

গারো আদিবাসি শিশু 
গারো জাতি মূলত উত্তর পূর্ব ভারতের বাসিন্দা, বিশেষ করে মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড়কে ঘিরেই তাদের বসবাস । যাই হোক, এই জাতি গোষ্ঠীর কয়েকটি আবার শাখা প্রশাখা বা উপগোষ্ঠী রয়েছে যা অন্যান্য এলাকাতে বিক্ষিপ্ত ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করে থাকে । আসামের প্রতিবেশী রাজ্য, অন্যান্য উত্তর-পূর্ব রাজ্য, পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলাতে গারো আদিবাসীর বসবাস পরিলক্ষিত হয় । এই এলাকার ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা বা পার্থক্যের কারণে, গারো জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন সম্প্রদায় বা গোত্র ভারতের মেঘালয়ের সমগ্র অঞ্চলেই বিস্তৃতি লাভ করে । মূলত এই গবেষনায় মেঘালয় রাজ্যে ও তার আশপাশে বসবাসকারী গারোদের সামাজিক ব্যবস্থা সম্পর্কেই তুলে ধরা হয়েছে ।
“গারো”  কেন বলা হয়?
“গারো” নামের অর্থ কি?
“গারো” শব্দ দিয়ে কি বুঝানো হয়?
এ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের মতবাদ, মতর্পাথক্য বা মতভেদ রয়েছে যা আমরা বিভিন্ন গবেষকদের আলোচনা ও বর্ননা থেকে জানতে পারি  ।
১) ভারতের এক মেজর প্লেফেয়ার তার  “দ্যা গারোস” নামক গবেষনা মূলক একটি বই এ উল্লেখ করেন যে,  প্রথমে “গারো” শব্দটি “গারা” বা “গাঞ্চিং”  গারো পাহাড়ের দক্ষিনদিকে যে জনগোষ্ঠী বা উপগোষ্ঠী বসবাস করতো তাদেরকে এ উপাধিতে ভুষিত করা হয়েছিল।
(Major A. Playfair in his work “The Garos” holds that Gara or Ganching is a sub-tribe which first received the appellation of Garo who lived in the southern portion of the Garo Hills.)

ধীরে ধীরে এ নাম পাহাড়ী অঞ্চলের সব অধিবাসীদের মাঝে বিস্তৃতি লাভ  করে । মেজর তার এ গবেষনাধর্মী বই এ আরো উল্লেখ করেন যে, “গারো” শব্দটি এ অধিবাসীদের মানুষজন প্রথমে “গারো” শব্দটিকে একটি বিকৃতরুপে বা বিকৃতভাবে ব্যবহার করতো বলে উল্লেখ করেন বা যারা খারাপ কাজ করতো র্দুনীতি করতো যাদের কাজ সমাজে গ্রহন করা হতোনা তাদেরকেই “গারো” নামে ডাকা হতো।

গারোদের গৃহ(মেঘালয়ের)
২) জে. বি. ভট্টাচার্য্য “দ্য ইংলিশ" (১৯৭৮) নামক বই এ লিখেছেন, “গারো” জনগোষ্ঠী গুলোর মধ্যে একটি গোত্র রয়েছে যাদেরকে “গারা-গাঞ্চিং” বলা হতো, যারা গারো পাহাড়ের দক্ষিণ অংশে বসবাস করে আসছিল অনেকদিন থেকেই । তাঁর মতে সময়ের বিবর্তনে “গারো” শব্দটি “গারা-গাঞ্চিং”  থেকেই বিবর্তিত হয়েছে এই “গারো” শব্দটি।

জে. বি. ভট্টাচার্য্য বলেন, এভাবেই “গারা” মূল শব্দ হতে পরিবর্তিত হয়ে “গারো” শব্দটি রুপ লাভ করে । “গারা” হলো মূলত একটি ভাষা ।  তার আরেকটি সংস্করণমূলক পুস্তক এ, গারো এর উৎপত্তি সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, তিব্বত থেকে যে অধিবাসীরা কালের বিবর্তনে মেঘালয় রাজ্যে স্থানান্তরিত হয়ে চলে আসে তাদের মধ্যে একজন নেতা ছিলেন যার নাম “গারু” এধৎঁ, মূলত সেই নেতাকে যারা অনুসরন করে তিব্বত থেকে মেঘালয়ে চলে আসে তাদেরকে তাদের নেতার নাম অনুসারে “গারো” বলা হয়ে থাকতে পারে বলে উল্লেখ করেন।
Another version on the origin of the term ‘Garo’ is that while the tribe of our discussion was migrating from Tibet they had a leader whose name was ‘Garu \ It is very probable that after his name the followers came to be known as ‘Garos

৩) প্রাচীনকালে বর্তমানে যাকে “তুরা” র্অথাৎ মেঘালয়ের যে জেলা শহর  বলি,  সেটা “ধুরা” নামে পরিচিত ছিল যা “ধুরামা পাহাড়” থেকে এসেছে বলে ধারনা করা হয় ।
In the former days Tura* was known as ‘Dhura’ derived from the ‘Durama Hill’.
৪) আরেকটি মতবাদ হলো “গারো’’ শব্দটি একটি পরিবর্তীত নাম বলে ধারনা করা হয়, যা অন্য শব্দ থেকে ধারন করেছে বলা হয়ে থাকে বা অন্য শব্দ থেকে রুপান্তরিত হয়েছে বলে বলে মনে করা হয়। যেমন “ধুরা” থেকে “তুরা ” হয়েছে । গোয়াল পাড়ার দক্ষিণে পাহাড়ী অঞ্চলে বসবাসকারী মানববসতি যারা আসাম জেলায় বসবাসরত তারা “গারো’’ শব্দটির উৎপত্তি সম্পর্কে আরও ভিন্ন একটি ধারণা পোষন করেন । তারা মনে করেন “গৌড়” শব্দটি ভারতের একটি ইতিহাসে ছিল সেই ইতিহাসে তারা খোঁজে পায় যে, ১০০০ খৃষ্টাব্দে বর্তমানে যা বেঙ্গল (বঙ্গ) নামে পরিচিত সেখানে একটি  “গৌড়’’ নামে সমৃদ্ধশালী রাজ্য ছিল । এ ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, ১১৯৮ খৃষ্টাব্দে থেকে ২০০০ বছর পর্যন্ত ইতিহাস এর তথ্য অনুসারে “গৌড়’’ নামে একটি বঙ্গ রাজধানী শহর ছিল এবং “গৌড়’’ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল যা বাংলার রাজধানী নামে খ্যাত ছিল এবং তার এ রাজত্ব মুসলীম আমলে বখতিয়ার তা ধবংস ও নিশ্চিহ্ন করে দেয় ।
“গৌড়’’ হলো একটি ভুলে যাওয়া কবরস্থান যা একচ্ছত্রভাবে বা নিরবচ্ছিন্নভাবে মৃত্যপুরী হয়ে থাকতো, এমন মনে করা  হতো । এরপর এই একটি ছাড়া ইতিহাসে আর কোন “গৌড়’’ নামে কোন বাংলা রাজ্যের সন্ধান পাওয়া যায়নি ।

১১৯৮ খৃষ্টাব্দ থেকে আরেক নতুন বিজয় ইতিহাস সূচিত হয় ।  অনেকেই আবার বিশ^াস করে থাকেন যে, “গারো’’ নামটি “গৌড়’’ থেকেই নামাকরন করা হয়েছে, আক্ষরিক অর্থে “গৌড়’’ মানে হলো “বাইসন’’ বা “বন্য বাছুর’’ যা একসময় শক্তিশালী গৌড় রাজ্যের জাতীয় প্রতীক ছিল বলে ইতিহাসে পাওয়া যায় । গারোদের মধ্যে প্রথম গারো লেখক “রামকে ডবিøউ মমিন’’ বলেন “গারো’’ শব্দটি “গৌড়’’ থেকেই এসেছে তা বর্ণনা করেন এভাবে। 
 ÒAgain Gaur literally means Bison or wild bull, which was the national symbol of the once mighty Gaur Raj. Ramke W. Momin, one of the earliest Garo writers of the view that the word Garo has been derived from the term ‘GaurÕÕ

তুরা হলো পশ্চিম গারো পাহাড়ের জেলা সদর দপ্তর । “গৌড়’’ এ গারো ছাড়া আর কোন জনগোষ্ঠী ছিলনা । এই দৃশ্যটি পূর্বের পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশ) উর্বর এবং সুন্দর সমভূমি বৃটিশদের দ্বারা একবার গারো দেশ হিসাবে পরিচিত  হয়ে উঠেছিল কারন বৃটিশ সরকার এ জায়গাকে গারোদের দেশ হিসাবে মনে করতো । পরে এ অঞ্চলটি পাকিস্তান এর সাথে মিশে এক হয়ে যায় ।
গারো নকপান্থে- সংগৃহীত (মেঘালয়) 
একই রকম বিষয় ৪৮তম “বোডো” বার্ষিক সম্মেলনের সাহিত্য সভায় যে স্মৃতিসৌধ করা হয় সেটি তার প্রমান পাওয়া যায়। কানুরাম হাজং তার প্রবন্ধে "বোরো, গারো আর হাজং সমাজ একই সাদৃশ্যপূর্ন" বলে উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশ "বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তর পশ্চিম অংশে " গাউ কিন্ডম " ছিল। ব্র্রহ্মপুত্র উপত্যকায় আসার আগে এবং তাদের ট্র্যাক্টে প্রবেশ করার আগে তারা “গৌড়’’ রাজ্যের বাসিন্দা ছিল। গৌড় রাজ্য থেকে তাদের অভিবাসনের কারণে তারা গারো নামে পরিচিত হয়ে ছিল বলে জানা যায় । 

লেখক মেজর প্লেফেয়ার এর আরেকটি উদ্ধৃত ও পর্যালোচনা থেকে পাওয়া যায় যে, গারোদের মধ্যে একটি বিশ্বাস আছে যে, তাদের পূর্ব পুরুষদের নাম ছিল নর-মানুষ (নর-মান্দি)। তাই তারা তাদের পিতার নাম অনুসারে নিজেদেরকে নর-মানুষ বা নর-মান্দি নামে ডেকেছিল ও সেই নামে নাম দিয়েছিল। তবে পরে তারা নর-কে প্রত্যাখ্যান করে নিজেদেরকে “মান্দি’’ বলতে শুরু করে, “মান্দি’’ শব্দের অর্থ হলো “মানুষ”।

“গারো’’ শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ডঃ জে এল আর মারাক, নাগেন্দ্র নাথ বসুর  উদ্বৃতি দিয়ে উল্লেখ করেন যে, গারো শব্দটির মূল শব্দ হলো “গারুদাস”  পূর্বে প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন সাহিত্য লেখনীতে এ নাম এর অস্তিত্ব পাওয়া যায় । প্রাচীন ভারতীয় কিছু মহাকাব্যগুলিতে “মান্দি’’ এবং “গারুদাস’’ এর উল্লেখ রয়েছে ।
While discussing about the origin of the term ‘Garo” Dr. J.L.R. Marak refers to the views on Nagendra Nath Vasu who hols that the term Garo has its root in the word ÒGarudas” He draws some reference from ancient Indian Literature. Ancient Indian epics contain some identical reference to the ‘Mande” and “Garudas”.

ভয়ংকর একটি লৌহিত সাগর এর উপকুলে লাল পানির ঝর্ণা যেখানে প্রবাহিত হতো সেখান হতে গুরুদার বাড়ী একটু দূরে ছিল, লিথুনিয়া সাগর, পাখির রাজা, ভারতের পূর্বাংশের রামায়নে “গারুদাসের বাড়ীকে “গারুদাচালা’’ নামে পরিচিতি ছিল বলে জানা যায় । ইহার মধ্যে কিছু পাহাড়ী জনগোষ্ঠী পাহাড়ে অর্থাৎ গারুদাচালায় বসবাস ছিল বলে বর্ণনা করা আছে ।

The description of the eastern part of India in the Ramayan, Kishkindhya. Chapter 40..

এছাড়াও পরিচিত ছিল মাইডাই বা গারুদা হিসাবে। তখন তাদের বাসস্থান হিসাবে পরিচিত হয় । গরুদাচলা এখন গরুদাচলা গারো পাহাড় নামে পরিচিত। মনু সংহিতা ও কালিক পুরানা, ১০ খৃষ্টাব্দে একটি কাজ কে বর্ননা করে বলেন যে, ম্যান্ডেহাসের স্বদেশ সমুদ্রের তীরে ছিল যা লোহিত্য সাগর বা লাল সমুদ্র বলে পরিচিত ছিল। লোহিত সাগর নামেও এর আগে পরিচিতি ছিল যার অর্থ পূর্ব সাগর। তাছাড়া, ১৬ শতাব্দীতে “যুগিনী’’ আবাসিক এলাকায় একটি রেফারেন্স আছে “সাইমা’’ যা “ম্যান্দি সিলা’’ নামে পরিচিত ছিল বলে জানা যায়। অনুমান করা হয় যে, “ম্যান্দি সিলা’’ নামটি “ম্যান্ডেহা’’ থেকে এসেছে যা বিভিন্ন লেখনীতে পাওয়া যায় ।

রামায়ণ ১২ (ক) পি. সি. নাথ সম্মত হন যে, এক সময় এক পাখি সিতাকে উদ্ধার করার চেষ্টা করেছিল রাবণ এর গাত থেকে । সেই পাখি হলো, পাখিদের রাজা গারুদা এবং গারো নামটি ছিল গারুদা নাম থেকে  প্রাপ্ত । তবে, অন্য আরেকটি মতবাদ অনুসারে অগারো, অন্য জাতি, বাঙালি ও আসামী জাতি যারা আসামে সমতলে  বসবাসকারী ছিল, তারা এই আদিবাসী গোষ্ঠীকে 'গারো' বলে আখ্যায়িত করা হতো।

কেন তারা “গারো’’ বলে পরিচিত এ সম্পর্কে এডওয়াার্ড টি. ডাল্টন নামে এক গবেষক তার একটি গবেষনায় তুলে ধরেন । তিনি বলেন ঐ এলাকায় নাগা, হিন্দু যারা বসবাস করতো তারা এই বিশেস আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে “গারো” নামে অভিহিত করতো ।  দেরী জ্যাবং ডি. মাারাকের মতে, “গারো” ঐতিহাসিক একটি নাম, সেখানে তিব্বতের মধ্যভাগে বসবাসরত বিভিন্ন পাহাড়ি জনগোষ্ঠী ছিল। সেখানে আরও ছিল “গারু প্রদেশ’’ নামে পরিচিত একটি স্থান, যার বাসিন্দাদের “গারু’’ বলা হতো ।

অথবা এটা অনুমিত হয় যে, সেই “গারো’’ জায়গা থেকে গারোরা ভারতে এসেছিল। ১৯৮১-৮২ সালের “অল ইন্ডিয়া গারো ইউনিয়ন’’ এর স্যুভেনির এ উল্লেখ করে, মিহির এন. সাংমা লিখেছেন যে “গারো’’ শব্দটি “বোডো’’ থেকে এসেছে ,  “বোডো’’ হলো একটি ভাষা । পি. সি. ভট্টাচার্য্য তাঁর আরেক নোটে “বোডো’’, “গারো’’ এবং “সানস’’ পরস্পর একটি আরেকটির অনুরূপ বলে প্রকাশ করেন। তিনি বলেন যে “গারো’’ একটি ইঁদুর হতে উৎপত্তি হয়ে থাকতে পারে। “গারো’’ বৃহত্তর "বোরো" হতে বিভক্ত একটি উপজাতি বলেও  তিনি উল্লেখ করেন ।
মান্দিহাসরা আবার মান্দাই বা গারুদা নামেও পরিচিত ছিল । তাদের যেখানে বসতি ছিল তাকে গারুদাচল বলা হতো । বর্তমানে এই গারুদাচলকেই গারো হিলস বা গারোপাহাড় বলা হচ্ছে । ম্যানু সামহিতা এবং কলিকা পুরোনো এর ১০ম শতাব্দীর একটি লেখনীতে আরো বলা হয় যে, মান্দিহাসদের মাতৃভূমি লোহিত সাগড়ের তীরে বা লাল সমুদ্রের উপতক্যায় ছিল । লোহিত সাগড়কে পূর্বসাগরও বলা হয় ।

১৬শ শতাব্দিতে আইগিনি টানতারা নামে একজন গবেষক তার একটি লেখনীতে উল্লেখ করেন যে, মান্দাইদের একটি বসতি ছিল যা মান্দি-সাইলা নামে পরিচিত ছিল । বিভিন্ন পুর্বপুরুষেরা মনে করেন যে, মান্দি সাইলা নামটি মান্দিহা থেকে এসেছে । যা রামায়ন এর ১২ (এ)তে পাওয়া যায় । পি.সি. নাথ তার সাথে একমত পোষন করে বলেন যে, গারোদা পাখিদের রাজা, যে পাখি রাবনের হাত থেকে সীতাকে উদ্ধার করতে চেষ্টা করেছিল এবং এই গারোদা নাম থেকেই পরিবর্তিত হয়ে গারো নামটি ধারন করা হয়েছে । যাই হোক, এরপরও কিছু পন্ডিত ব্যাক্তি যারা বাঙালী এবং আসামের সমতল এর বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাস করে আসছিল , তারাই এ আদিবাসী গোষ্ঠীকে “গারো’’ নামে অভিহিত করতো এবং এ নামেই ডাকতো ।

এ কারনে তারা গারো নামেই পরিচিত । এডওয়ার্ড টি ডালটন বলেন যে, কিছু হিন্দু জাতির মানুষজন মনে করেন গারো হলো নাগাদের মতো । হিন্দুরা যে এই শব্দ প্রয়োগ করেছে, তা অনেক আগের ইতিহাসে পাওয়া যায় । গারো ঐতিহাসিক লেখক জাবং ডি মারাক এর মতে, সেখানে গারু বা গারো নামে একটি বসতি ছিল যা গারো প্রদেশ নামে পরিচিত ছিল যা ভারতের একটি অংশে অবস্থিত ছিল । অনেকেই বিশ্বাস করে থাকে যে,  গারো জাতি  হলো বোরো জাতি এর একটি শাখা বা উপজাতি যার মধ্যে কিছু ভিন্নতা রয়েছে ।

প্রধান উপজাতি থেকে, বোডো ভাষায় গারো- অর্থ আলাদা এবং স্থানান্তরিত করার সময় গারো-গলোলং মানে ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হওয়া বা আলাদা । বোরো জাতি গারো জনগোষ্ঠীকে তাদের ভাই হিসাবে বিবেচনা করে থাকে, যাঁরা অনেক আগে থেকেই তাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিল বলে মনে করে তারা। তারা এই বিচ্ছিন্ন ভাইদের “গাও” বা “গারো” বলে অভিহিত করে এবং তাদের জায়গায় বসতি স্থাপন না করে অন্য স্থানে স্থানান্তরিত হয়। “গারো’’ শব্দটি পরবর্তী কয়েক বছরে ব্যবহৃত হতে থাকে চারিদিকে। সাধারণ ভাবে এই মতবাদে সম্মত হয় যে, ভাষাগতভাবে এবং নৃতাত্তিকভাবে “গারো’’ “বোডো’’ পরিবারের অন্তর্গত। লেক্সিকো-পরিসংখ্যানগত একটি বিশ্লেষণটি দেখায় যে ,“গারো’’ এবং “বোডো’’ উভয়ই প্রথম সহ¯্রাব্দে একই ভাষা ব্যবহার করতো  ।

আরেকটি মতবাদের সাথে একমত হয়ে বলে থাকে যে, যে গোত্রটি তিব্বত থেকে স্থানান্তরিত হয়েছিল এবং প্রথমে কুচবিহার ও প্রতিবেশী এলাকায় বসতি স্থাপন করে, তারা এই জমিটিকে বা স্থানটিকে "আংশ পাতারী” এবং চিগা সুচ (কুচ বিহার) নামে ডাকতো । সেখানে তারা প্রায় ৪০০ বছর ধরে বসবাস করে, ইতিহাস অনুসারে তখন সেখানে ২১ জন গারো আদিবাসী মাংস ভোজনকারী ছিল, কিন্তু সেই সময় কুচ-বিহারের অন্য জনগোষ্ঠী যারা ছিল, তারা এ মাংস খাওয়া সংস্কৃতিকে পছন্দ করত না। যারা মাংস খেতো তাদেরকে সমতলের জনগোষ্ঠী তখন অপরাধ করেছে বলে গণ্য করতো। কুচ বিহারের রাজা চেষ্টা করেছিলেন যাতে তারা মাংস না খায় কিন্তু মাংস খাওয়া থেকে তাদের বিরত রাখতে ব্যর্থ হন। তাই তিনি বিভিন্ন উপায়ে তাদেরকে অত্যাচার করতে শুরু করলেন যাতে কুচ বিহার এলাকা নিজে নিজেই ছাড়ে এবং অন্যখানে চলে যায় । এভাবে কুচ বিহারের লোকেরা তাদেরকে "গুরূ" (¯স্ল্যাং) বলে অভিহিত করে যার মানে গরু মাংস বা বোকা।

আরেকটি মতবাদ হলো, “গারো’’ শব্দটি "গৌড়" থেকে নেওয়া হয়েছে বলে মনে করেন ড. (রেভা) গিলবার্ট মারাক, তার মতে "গারো" শব্দটি দুটি শব্দ থেকে উদ্ভূত হয়েছে। 'গা' এবং 'ররো' এই দুটি শব্দ । 'গা' মানে ভূমি আর রোর অর্থ হলো ধারাবাহিকতা। এভাবে “গারো-রোর” থেকে উৎপন্ন "গারো" একটি একক শব্দ । গারোরা বিভিন্ন স্থানে বা এক স্থান থেকে অন্যস্থানে স্থানান্তরিত হয়ে হয়ে অভিবাসিত হতে হতে অবশেষে তাদের বর্তমান মাতৃভূমি গারো পাহাড়ে বসতি স্থাপন করে।
তাদের অভিবাসনের সময় তারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় দীর্ঘকাল বসতি স্থাপন করে । তারা এক জায়গায় থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত হয়েছে এবং জায়গা পরিবর্তন করেছে । সুতরাং এটি একটি খুব দীর্ঘ এবং চলমান একটি প্রক্রিয়া ছিল তাদের। এই বিশ্লেষণ থেকে পাওয়া যায় যে গারো শব্দটি নিজেই একটি স্বয়ংক্রিয় শব্দ যা তাদের বৈশিষ্ট্যের সাথে মিল রয়েছে ।

মিঃ সুরোসন জি. মোমিন, সাবেক গারো সাহিত্য সভার সভাপতিত্ব করার সময় বলেন যে, গারো শব্দ আসলেই একটি আচিক শব্দ না । গারোরা প্রধানত ঝুম চাষ পদ্ধতি গ্রহণ করে জীবিকা নির্বাহ করতো যা 'আসামিদের' কাছে গারস সিস্টেম বা গারোদের পদ্ধতি হিসাবে পরিচিত ছিল। আ হলো মাটি , আব্রি হলো পাহাড় এবং চিক শব্দ মানে কামড় বুঝায়।

ব্রিটিশরা পাহাড়ী এলাকাটিকে "গারো হিলস" বলে ডাকতে শুরু করে যেখানে ঝুম চাষের জনগোষ্ঠী ঝুম পদ্ধতি অনুশীলন করতো এবং ঝুম চাষ করতো। কিছু গারো মানুষ সে সময়ে নিজের সুবিধা গ্রহন করার জন্য নিজের ঈচ্ছামন আচরন করতো তারা কারো বুদ্ধি, পরামর্শ বা চেতনা গ্রহন করতো না এজন্য যারা গারো জনসমষ্টির বাইরের লোক তারা "গাগারু" (অর্থাৎ গরু মত বোকা) বলতে শুরু করে। মূলত এই গারো শব্দটি সমতলভূমির অ-উপজাতীয়দের দ্বারা ব্যবহার হতো পাহাড়ী উপজাতি জনগোষ্ঠীদের বুঝানোর জন্য । তাদের নামানুসারেই ইংরেজরা এই পাহাড়ী জনগোষ্ঠীকে গারু বলে সম্ভোধন করতে থাকে যা পরবর্তীতে ডাকতে শুরু করে যা গারো নামেই প্রতিষ্ঠিত হয় ।

পূর্বপুরুয়েরা ও নৃতাত্বিকরা তত্বগত ও ঐতিহাসিক বিভিন্ন সুত্র থেকে মনে করে যে, গারো শব্দ টি বোদো থেকেই উৎপত্তি হয়েছে । গারো গোষ্ঠী এবং বোদো গোষ্ঠী উভয়েই বোদো পরিবারের অর্ন্তগত যা তিব্বত-বার্মা জাতীয় গোষ্ঠী । তাদের আঞ্চলিক ভাষায় “বোধ” মানে হলো “তুষার” এবং “বোধ বিসা” মানে হলো “তুষার সন্তান” । গারো এবং বোধো ভাষায় একই অর্থ বহন করে  “তুষার সন্তান”। ডঃ মিল্টন সাংমা বলেন যে, বোধ হলো তিব্বতীয় ভাষা সুতরাং উনি তুলে ধরেন যে, বোধো ভাষা যারা ব্যবহার করে, বোধো ভাষায় কথা বলে তারা তিব্বত থেকে অবিভাসিত হয়েছে ।   

যদিও এই উপজাতি গোষ্ঠীটি 'গারো' নামে পরিচিত ছিল তবুও এ সম্প্র্রদায়েরর সদস্যরা নিজেদেরকে গারো বলতো বরং নিজেদেরকে “আচিক মান্দি” বলে পরিচয় দিতো । তারা নিজেদের মধ্যে যে নাম ব্যবহার করে তা 'গারো” না কিন্তু  আ-চিক-রাং- যার মানে হলো পাহাড়ী মানুষ বা মানদিরাং যার মানে হলো মানুষগুলো । ডঃ জুলিয়াস এল আর মারাক ব্যখ্যা করেন যে, “গারো রা নিজেদেরকে আচিক বলে ডাকে যার মানে হলো পাহাড়ী মানুষ, মান্দি মানে হলো একজন মানুষ বা আচিক মান্দি মানে হলো পাহাড়ী মানুষ । তারপরও ব্রিটিশ সরকারও অফিসিয়াল ভাষায় আচিক এর পরিবর্তে গারো নামেই ব্যবহার করা শুরু করে সেই সময়েই ।

মেঘালয় একটি পাহাড়ী এলাকা যারা সেখানে বসবাস করে তাদের গোষ্ঠীর উপর ভিত্তি করে এটি গারো হিলস বা গারো পাহাড় নামে পরিচিত । এটি একটি অবাক করা বিষয় যে, নিজেদের ভাষায় গারো নামের কোন অর্থ নাই এবং কোন অর্থই বোঝায়না । তাদের লোকগীতি বা বিভিন্ন লেখোনীতে এ গারো নামের কোন শব্দ ব্যবহৃত নেই, হয়নি এটি অন্য জনগোষ্ঠী দ্বারা ব্যবহৃত একটি শব্দ বা উপাধি মাত্র । যদিও আশেপাশের জনগোষ্ঠী তাদেরকে ঐতিহ্যগত ভাবে গারো নামে সম্বোধন করতে ভালবাসে  । যেমনঃ “আ চিক মান্দি” এই  শব্দ অফিসিয়াল ভাবে কোথাও ব্যবহৃত হতোনা । এই “আচিক” শব্দটি পাহাড় হিসাবে ব্যবহৃত হয় এবং জানে । গারো গোষ্ঠীরা যে পাহাড় এলাকায় বসবাস করে সে অঞ্চলকে পাহাড়ী অঞ্চল বলে জানে যা “আচিক” নামে জানে । তারপরও যে গারো আদিবাসীরা সমতল অঞ্চলে বসবাস করে তারাও নিজেদের কে “আচিক” বলে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে এবং পাহাড়ী জনগন তাদের আত্বীয় বলেই মনে করে । তারা নিজেদেরকে “আচিক” বলে পরিচয় দিতেই ভালবাসে অর্থাৎ “পাহাড়ী মানুষ” বলতেই তারা ভালবাসে । এমনকি আজও  “আচিক মান্দি” নামেই ব্যবহৃত হয় আসাম, পশ্চিমবঙ্গের সমতল জেলাগুলিতে এবং বাংলাদেশে বসবাসকারী গারো আদিবাসী জনগোষ্ঠীদেরকে।

প্লেফেয়ার আরও বলেছিলেন যে, গারোরা কখনও গারো শব্দটি ব্যবহার করেন না যদিও বিদেশী বা ননগারোরা তা ব্যবহার করে। তারা সবসময় নিজেদেরকে আচিক মান্দি বা পাহাড়ী মানুষ - নামেই পরিচয় দেয় । ডিএন মজুমদার প্লেফেয়ারের মতামত এর সাথে সহমত পোষন করেন । মান্দি শব্দটি মানুষ শব্দের সমাহার । মান্দি শব্দের দুইটি অংশ রয়েছে । প্রথম অংশ মান, যার অর্থ হলো মান একটি উপজাতির নাম এবং দি হলো গারো শব্দ যার অর্থ শিশু । অতপর, মান্দি বা মান-দি অর্থ হলো মান(গোষ্ঠী) এর সন্তান । মনে করা হয় যে, সম্ভবত মান শব্দটি হয়তো আসামী জনগন মানে বার্মার(বার্মিজ) জনগন থেকেই এসেছে ।

তিনটি পরপর আসামে বার্মিজ হামলার কথা (১৮২০) এখনও কোলকোয়াল আসামের লোকেরা “মাননর আক্রমন”  বলে মনে করে যা র্বামার লোকেরা মান মানে দেশ হিসাবে জানে । বার্মার আক্রমন অর্থাৎ বর্তমান মায়ানমারের লোকজন দ্বারা আক্রমন হয়েছে বলে ধরে নেয়া হয় । র্বামার জনগন আর কেউ নন, তাদেরকেউ আসামের জনগন “মাআন”  বলেই  সম্বোধন করে ।  “মাআন” শব্দটি ”মায়ান” শব্দের মতই । সুতরাং এভাবেই বলা যেতে পারে যে, মান্দি জনগন র্বামার মায়ানমার থেকেই এসেছে । বাংলার একটি প্রকাশিত গেজেট এ বলা হয় যে “গারো” হলো তিব্বত-র্বামার একটি খন্ড মাত্র । অন্য আরেকটি মৃত্যুর ঘটনার বর্নণা থেকে বলা যায় যে, আচিক এমন আরেকটি অর্থ বুঝায় যা, আ- হলো মাটি এব চিক- হলো কামড় দেয়া বা আচিক মানে মাটি কামড় দিয়ে থাকা বুঝায় ।

(Changing status of women in Matrilineal Garo society- Shri Anjan Jayoti Borah-August 2010) এই বই হতে অনুবাদিত ।
চলবে-------------

মন্তব্যসমূহ

আলোছায়া কথামালা

গারোদের উৎপত্তি, সমাজ ব্যবস্থা, কৃষ্টি-সংস্কৃতি, বিবাহ প্রথা ও মাতৃসূত্রীয় প্রথা