গারো সাম্প্রদায়ের আত্নীয় সম্পর্ক পদ্ধতি (গারোদের উৎপত্তি, সমাজ ব্যবস্থা, কৃষ্টি-সংস্কৃতি, বিবাহ প্রথা ও মাতৃসূত্রীয় প্রথা - ৩য় পর্ব)


প্রতিটি সমাজের আত্নীয় সম্পর্ক হলো একটি স্বাতন্ত্র উপাদান । এটি একটি সম্প্রদায়ের সামাজিক জীবনে গুরুত্বপূর্ন  ভূমিকা পালন ও গ্রহন করে । আদিবাসী সম্প্রদায়ের সমাজগুলি নিজস্ব একটি আত্নীয়তা সম্পর্ক সিস্টেম দিয়ে চিহ্নিত করা হয় । গারো সমাজের সাম্প্রদায়িক আত্নীয় সম্পর্ক নিম্নরুপঃ

গারো সম্প্রদায়ের সমাজে একটি গুরুত্বপুর্ন অংশ হলো আত্নীয়তা সমপর্ক যা বংশের মাধ্যেমে সম্পর্কযুক্ত । গারো সমাজে ৫টি বংশজাত গোত্র রয়েছে বলে উল্লেখ রয়েছে  । এই বংশকে গারো ভাষায় বলে চাচ্চি । এই ৫টি চাচ্চি হলো সাংমা, মারাক, মমিন, আরেং এবং শির । প্রতিটি বংশের আরো উপশাখা বা উপবংশ রয়েছে । এই উপশাখাকে বলা হয় মা-চং । চাচ্চি অর্থ হলো একজন আরেকজনের সাথে আত্নীয় বা রক্ত সম্পর্ক যেখানে মাচং হলো একজন মায়ের বংশজাত উত্তরাধিকারীগন । মা হলো মা বা মাদার, চং হলো দল, চাচ্চি হলো বংশ/ক্লান এবং মাচং হলো উপবংশ/সাবক্লান । প্রকৃতপক্ষে তাদের মূলত দুই ভাগই ছিল বলে ধারনা করা হয় । সেটি হলো সাংমা মাচং এবং মারাক মাচং । আরেং, সিরা ও মমিন ঐ দুইয়ের মধ্যেই অন্তভুৃক্ত ।

আরেং বংশটি সাংমা থেকে এবং সিরা বংশ মারাক হতে উদ্ভব হয়েছে বলা হয়ে থাকে । তৃতীয় যে বংশ মমিন ১৬৬১ সালে আসামে আক্রমনের সময় একজন বিহার এর মুসলামানের সাথে গারো মেয়ের সম্পর্ক হয় যার কারনে তাদের থেকে মমিন উদ্ভুত হয় । যা বর্তমানে সাংমা, মারাক, আরেং, সিরা এবং মমিন এ ৫টি বংশ/ বিভাগ গারো সম্প্রদায়ের মধ্যে ।

প্লেফেয়ার এর মতে গারোদের মধ্যে তিনটি চাচ্চি রয়েছে বলে উল্লেখ করেন সেটি হলো, সাংমা , মারাক ও মমিন । তিনি আরেং এবং শিরা কে আলাদা বংশ বলে বিবেচনা করেননি । তিনি বিশ্বাস  করেন এরা একসময় মমিন ছিল । তিনি আরো তুলে ধরেন যে, এই মমিন বংশ কোন কারনে তাদের অভিভাবকদের ত্যাগ করে অনত্র একসাথে হয়ে একত্রে একটু দূরে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেছিল । আবেং, আরেং ও শিরা চাচ্চিরা একক স্বতন্ত্র বংশ  বর্তমানে আবেং নামে কোন চাচ্চিই নেই ।
   
এই বিষয়ে রবিন বার্লিনস লিখেছেন যে,  “প্রত্যেক গারোজনগনই বিশ্বাসকরে যে, তিনি সেই ৫টি মাতৃসুত্রীয় বংশ থেকে তার উৎপত্তি হয়েছে বলে নিজেকে বিবেচনা করে । যা আদর্শগতভাবে সম্পুর্ন এক ধরনের বর্নবাদী” বার্লিং এর মতে দুইটি গোষ্ঠী তুলনা মূলক ভাবে অন্য গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় অনেক ছোট । তারা এত অল্প এবং এত কম যে, কোন কোন এলাকায় গারো হিসাবেই তারা পরিচিত নয় । তারপর তিনি আরো বলেন, মমিন একটি বড় গোষ্ঠী কিন্তু এখনও কিছু গারো এলাকাতেই তা সীমিত রয়েছে । পূর্বে দেখা যায় যে, সবাই জানতো গারোদের মধ্যে মাত্র তিনটি গোষ্ঠী রয়েছে, তা হলো সাংমা, মারাক ও মমিন । আরো দুইটি গোষ্ঠীকে সাংমা এবং মারাক এর মধ্যে গারো গোষ্ঠীরা যেখানে বসবাস করে তাদের সেখানে পাওয়া যায় । এ এলাকাগুলোকে ঐ বড় দুইটি গোত্রের মধ্যে যে কোন একটির অর্ন্তভুক্ত । বার্লিংস তাদেরকে “মযটটিস” নামেও অভিহিত করেছেন । বালির্ংস এর মত অনুসারে “মযটটিস” এর সদস্যভুক্ত গারো জনগোষ্ঠী স্বয়ংক্রিংভাবে উত্তরাধিারসূত্রে নিজের মায়ের কাছ থেকে প্রাপ্ত ও অর্জিত হয় ।
সাংমা এবং মারাক চাচ্চি প্রায় সব জায়গাতে পাওয়া যায় কিন্তু মমিন, আরেং এবং শীরা চাচ্চি আসাম জেলার গোয়ালপাড়া সিমান্তেই দেখা যায় । গারো সমাজে সাংমা, মারাক, আরেং, মমিন ও শিরা এই ৫টি চাচ্চিই বিদ্যমান রয়েছে । সংখ্যার দিক দিয়ে বিবেচনা করলে সাংমা এবং মারাক চাচ্চি বেশী তারপর বাকি চাচ্চিগুলো রয়েছে । এই উপ-গোষ্ঠী গুলোতে বংশানুক্রমে কিছু প্রথা বা সংস্কৃতি রয়েছে । যেখানে সাংমা এবং মারাক চাচ্চি গারো গোষ্ঠীর বসবাস সেখানে উপগোষ্ঠী মমিন, আরেং এবং শীরা সংযুক্ত । আরেং এবং শীরা চাচ্চির গারো উপ-গোষ্ঠীকে সাংমা থেকে উৎপত্তি হয়েছে বলা হয়ে থাকে ।

চাচ্চি সংক্রান্ত সম্পর্কযুক্ত যে আত্নীয়তা তা বিভিন্ন এলাকায় আবার বিভিন্ন রকম । কিছু এলাকাতে একটি উপগোষ্ঠী একটি গোষ্ঠীর সাথে সম্পর্কযুক্ত সেই উপ-গোষ্ঠীই আবার আরেক এলাকাতে আবার অন্য আরেকটি গোষ্ঠীর সাথে সম্পর্কযুক্ত । 

উদাহরন স্বরুপ উত্তর-পুর্ব অঞ্চলে “মাংসাং” উপ-গোষ্ঠী হলো মারাক গোষ্ঠী বা চাচ্চির অর্ন্তগত কিন্তু গারো পাহাড়ে তাদেরকে “চিসাক” উপ-জাতি বলা হয়ে থাকে । এই একই উপ-গোষ্ঠী দক্ষিন পশ্চিম এলাকাতে সাংমা চাচ্চির অন্তর্গত বলা হয়ে থাকে যেখানে তারা “আবেং” উপ-গোষ্ঠী বলে জানে । সুতরাং এই উপ-গোষ্ঠী কোন গোষ্ঠীর সাথে সম্পর্কিত তা এলাকাভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয় এবং সে এলাকার অনুশীলন অনুযায়ী হয় ।

M.C. Goswami and D.N. Majumdarতাদের গোষ্ঠী পদ্ধতি সম্পর্কিত  বিভিন্ন অবজারভেশনে বলেন, গারোদের এ সিস্টেম বিভিন্ন রকম বলে উল্লেখ করেছেন । ১৯৭২ সনে  “Social Institutions of the Garo of Meghalaya” (1972)  একটি কাজে তারা দেখান যে, শীরা চাচ্চিটি ডালবৎ উপ-গোষ্ঠীর অর্ন্তভুক্ত যেখানে আরেং চাচ্চি সম্পকির্ত নংবাক উপ-গোষ্ঠীর মধ্য থেকে এসেছে যা মারাক দলের ।
কিছু বৃহৎ উপ-গোষ্ঠীগুলো বিচ্ছিন্ন/বিচ্ছেদ হয়ে নিজেই একটি গোষ্ঠীতে পরিনত হয়েছে । যেমনঃ কিছু গাবিল গ্রামের মহিলারা ( পুর্ব-মধ্য গারো পাহাড়ের একটি গ্রাম)  মমিন চাচ্চি গোষ্ঠীর উদ্ভব । কিন্তু একই গোষ্ঠীর নারীরা সেই এলাকা থেকে তিন মাইল দূরে স্বাধীনভাবে যারা বসবাস করে তারা নিজেদেরকে গাবিল অভিবাবক গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন করে গাবিল দাবিদ নামে পরিচয় দিচ্ছে।  পরবর্তীতে তারা প্রথম গাবিল থেকে গাবিল দাবিদ নামে নামাকরন করে এবং গাবিল থেকে তারা আলাদা একটি স্বতন্ত্র গোষ্ঠী বা বংশ এবং প্রতিষ্ঠিত বলে মনে করে । নীচের উদাহরন দিয়ে বুঝানো হলোঃ

অরিজিনাল উপ বংশ - বিভাজিত বংশ
       গাবিল - চিংসিল - দাবিদ-  ওয়াটার- ওয়াচাকশি
       আগিতক         - জামদাপ- ককচেপ- রাংসা -
       দসিক - গিপি- গিটচাক

বার্লিন আরো লিখেন যে,  প্রত্যেক “মইটি” আবার আরো উপ-বিভাগে বিভক্ত তাদের বলা হয় “সিবস” । প্রত্যেক গ্রামে অন্তত মাতৃসূত্রীয়ভাবে একটি “সিবস” প্রতিষ্ঠিত হয় । সেই গ্রামে বসবাসরত সকল গারোই এই “সিবস” বংশের বংশজাত হয় এবং বংশজাত সদস্যগন সবাই এই গ্রামে বসতি স্থাপন করার অধিকার রাখে । কিছু গ্রাম অন্তর্ভুক্ত করা হয় একসাথে বসবাস করার জন্য এবং যদি কোন স্বামীর কয়েকজন স্ত্রী থাকে তাহলে আশে পাশে থাকে বা অনেক স্বামী অন্য গ্রামগুলোর স্ত্রীদের বিয়ে করে সেখানেই রাখে ।

অন্যান্য গ্রামে যদিওবা দুটিমাত্র স্থানীয় মাতৃসুত্রীয় বংশধরেরা বসবাস করার অধিকার লাভ করে এবংতারপরও তাদের বিবাহিত স্ত্রীদের আনার জন্য তাদের অধিকার থাকে । এই নতুন উপ-গোষ্ঠী গঠন সম্পকির্ত Dr. Caroline R. Marak একটি ভিন্ন মত ব্যক্ত করেন । মারাক এর মত অনুযায়ী, কিছু নারী তাদের বিবাহ নিয়ম না মেনে বিয়ে করেন । সেই ধরনের নারী তার মায়ের  গ্রাম থেকে সে স্থানান্তরিত হয়ে অন্য গ্রামে গিয়ে বসতি স্থাপন করে এবং তার মাচং-উপ গোষ্ঠী পরিবর্তন করে । তাদেরকে বলে “খেগিজা খিম্মা” যার অর্থ হলো , যাদের বিয়ে নিয়ম সম্মত নয় কারন তারা এ্কই গোত্রের আরেকজনকে বিয়ে করতে পারেনা ।

এমন ধরনের দম্পতি একটি নতুন উপ-গোষ্ঠীতে রুপান্তর করে সামাজিক কলংক ঘুচাতে এটি একটি অন্ধবিশ্বাস হিসাবেও বিবেচনা করে অনেকেই । এভাবেই নতুন উপ-গোত্রর তৈরী হয় বা সৃষ্টি হয় । রবিংস বার্লিন বলেন যে, এ ধরনের পুরুষ গারোরা একত্রিত হয়ে একটি নতুন গোত্র তেরী করে ।  এভাবে তারা যেখানে বিশেষভাবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে একত্রিত তারা একটি বন্ধন তৈরী করে এবং এক হয়ে নিজেদের সামাজিক, নিয়ম রীতিনীতি নিয়ন্ত্রিত করে, নতুন তৈরী করে ও সহভাগিতা করে ।  এই ধরনের সম্পর্কের কারনেই গারো গোষ্ঠীর মধ্যে একটা বড় একতার বন্ধন দেখতে পাওয়া যায ।

মেজর প্লেফেয়ার তার “The Garos”  প্রবন্ধে বলেছেন যে, গারোরা গারো পাহাড়ে আগমনের পর শক্তিশালী একটি চীফ এ পরিবর্তিত হয় । তারা অন্যান্যদের (গারো ছাড়া) দ্বারা তাদের সুবিধার জন্য দাস হিসাবে ব্যবহার করতো । তারা বিশেষ শ্রেনী কাজের জন্য বিশেষ গোত্রকে নির্ধারন করে ও সেভাবে কাজ ভাগ করে দিতো । এভাবে তাদের কাজ বংশগতভাবে হয়ে যায় । এর ফলে দেখা যায যে, এভাবেই নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন শ্রেনীতে বা গোত্রে বিভক্ত হয়ে যায় । যেমন- আবেংদেরকে তুলা তুলার কাজের জন্য,  আবার শুকরের মাংস খন্ডিত করার কাজ থাকতো আরেক গারা নামক গারো গোষ্ঠীর, কোচদের শুকনা মাছ প্রস্তোত করার জন্য, এবং চিশাকদের বাঁশ এর অংকুর সংগ্রহের জন্য নিযুক্ত করা হতো । 

যাই হোক, বর্তমানে এমন বিভাজন গারো সমাজে আর দেখা যায়না । প্রতিটি চাচ্চিই নিজেদের মাচং এর সংখ্যা অনুমোদিত বা অন্তভুর্ক্ত । যেমন- আগিতক, আমপাং, বাংশাল, চিম, থকসি, দারিং, বাংবংগ্রি, বাংজলগ্রি, মান্দা তারা হলো সাংমা চাচ্চির । আদকগ্রি, বলওয়ারি, চাম্বুগং, ওয়াগি, রাংসা ইত্যাদি হলো মারাক এর অন্তর্গত অংশ। গাবিল, ওয়াট্রে, রংচু, সাকা এগুলা মমিন চাচ্চির অংশ । দালবত হলো শিরা এর অংশ, দচিক, নংবাক, চিনকতা, ওয়াগি এরা আরেং এর অংশ । 

মাচং বা উপ-গোষ্ঠী পশু, পাখি, গাছ, বাঁশ, নদী এবং পাহাড়ের নামে বা বসতি স্থানের নামানুসারে হয়েছে বলে ধারনা হরা হয় । যেমনঃ দকগ্রি মাচং মারাক চাচ্চি এর অন্তর্ভুক্ত এবং বাংবংগ্রি মাচং সাংমা চাচ্চির অংশ এই নামটি গ্রামের নামানুসারে হয়েছে যেখানে তারা বসবাস করে । এইভাবে দপো মাচং পাখির নামানুসারে হয়েছে যার অর্থ গারো ভাষায় পেঁচা । বলওয়ারি মাচং গাছের নামানুসারে হয়েছে, গারা মাচং টিকটিকি রাজার নামানুসারে, চাম্বুগং এক ধরনের কাঠের নামানুসারে, মি চেং একধরনের সুগন্ধযুক্ত গাছের নামানুসারে হয় । উপগোষ্ঠী র্কতৃক তাদের প্রিয় ও পছন্দমত গাছ, নদী ও পাখির নামে নামাকরন করা হয় ।

কথিত আছে যে, গারোদের কিছু পূর্বপুরুষেরা “টটিমিস্ট” । অক্সফোর্ড ডিকশনারী (পি ৯৬১)অনুসারে যার র্অথ হলো “টটিমিস্ট” হলো কিছু সমাজের লোকজন দ্বারা একটি বিশ্বাস, প্রকৃতিক বস্তু যা প্রাণী বিশেষ এবং আধ্যাতিক ভাবে একটি শক্তির প্রতীক হিসাবে গৃহীত হয় । তবে D.N. Majumdar গারোদেরকে “টটিমিস্ট” নামে বিবেচনা করেননা । উনি দেখেন যে, মাচং টি কোন প্রানী বা গাছের নামানুসারে নির্ধারন করা হয়েছিল, তবে কোন আবেগীয় সম্পর্ক কোন লি্কং করতে চাননা বা কোন কিছু শক্তির সাথে উনি খোঁজে পাননি বলে মনে করেন। তারা এসব প্রানী দের হত্যা, আহত করা বা খাওয়া থেকে বিরত থাকতো এবং নিজেরা খেতোনা ।  তিনি বলেন, তাদের মধ্যে অতীতে এ ধরনের কোন সম্পর্ক ছিলনা কারো কোথাও এর ইঙ্গিত তিনি খোঁজে পাননি ।

মন্তব্যসমূহ

আলোছায়া কথামালা

গারোদের উৎপত্তি, সমাজ ব্যবস্থা, কৃষ্টি-সংস্কৃতি, বিবাহ প্রথা ও মাতৃসূত্রীয় প্রথা

গারো শব্দের উৎপত্তি ও বিভিন্ন মতবাদ (গারোদের উৎপত্তি, সমাজ ব্যবস্থা, কৃষ্টি-সংস্কৃতি, বিবাহ প্রথা ও মাতৃসূত্রীয় প্রথা -১ম পর্ব)