গারো জনগোষ্ঠীর মাইগ্রেশন /অভিবাসন ও বসতি স্থাপন- (গারোদের উৎপত্তি, সমাজ ব্যবস্থা, কৃষ্টি-সংস্কৃতি, বিবাহ প্রথা ও মাতৃসূত্রীয় প্রথা - ২য় পর্ব)



যদিও অভিবাসন সংক্রান্ত তারিখ ও কারনসমুহ সহ তেমন কোন যথাযথ প্রমানযোগ্য উৎস তথ্য উপাত্ত নেই তবুও গারো জনগোষ্ঠীর বিশ্লেষক ও গবেষকরা গারোদের বিশ্বাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, লোককাহিনী ও কিছু ঐতিহাসিক ঘটনার তথ্য থেকে অনুমান ও ধারনা করে গারোদের অভিবাসন ও বসতি স্থাপন সম্পর্কে তথ্য উপস্থাপন করেছেন।  এ সম্পর্কে প্লে ফেয়ার লিখেছেন যে, গারোদের তিব্বত থেকে কিভাবে সমতল থেকে পথব্রজে আগমন হয়েছে মেঘালয়ে, ব্রম্মপুত্র উপতক্যা থেকে কিভাবে হিমালয়ে আগমন ঘটেছে , এখন বর্তমানে যেখানে গারোরা বসতি স্থাপন করেছে সেখানে আসার তেমন কোন সুস্পষ্ট ও স্বতন্ত্র গল্প নেই বলে উল্লেখ করেন ।

বেশীরভাগ লোককাহিনী ও লোকগীতির মধ্যে তিব্বত সম্পর্কে অনেকবার উল্লেখ করা রয়েছে যা তিব্বত থেকে তাদের বসতি স্থানান্তর হয়েছে বলে কাহিনী রচিত রয়েছে । যেখানে তাদের বসতি ছিল সেখান থেকে তারা স্থনান্তরিত হয়েছে এই ঘটনা স্পষ্ট । এটি একটি উল্লেখযোগ্য কাহিনী যে, তাদের আসাম উপতক্যা থেকে তিব্বতে যে অবিভাসনের ঐতিহ্য  ও ইতিহাস রয়েছে এবং তা বর্তমানের গারো জনগোষ্ঠী মনে প্রানে তা  বিশ্বাস করে । এইচ কে বার পুজারি লিখেছেন যে, আমাদের কোন জনপ্রিয় ঐতিহ্য বা ইতিহাস নেই যাকে আমরা আমাদের অধিবাসীর উৎস হিসাবে বলতে পারি এবং ইহা শুধুমাত্র একটি অনুমান মাত্র কারন তিব্বতবাসীর সাথে ভাষাগত দিক দিয়ে মেঘালয়ের গারোদের অনেক মিল পাওয়া যায় কিন্তু মিল রয়েছে বলেই তা দিয়ে নিশ্চিত ভাবে তারা সেখান থেকে এসছে বলে প্রমানীত তা বলা যায়না ।

একটি হিমালয় পর্বত মেঘালয়কে তিব্বত থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে এবং তিব্বতের অধিবাসীদের মধ্যে যে মিলনবন্ধন , শারিরীক গঠন, অভ্যাস, কৃষ্টি সংস্কৃতি এগুলোর মধ্যে খুব সহজে মিল খোঁজে পাওয়া যায় বা সম্পর্ক রয়েছে বলা খুবই দুষ্কর ।

তা সত্বেও তারা এ দুই এলাকার বসতিদের মধ্যে এতই বন্ধুত্বপুর্ন মিল রয়েছে যে অনেক কিছুই খুব সম্পর্কযুক্ত ও এক, এমনকি তাদের ভাষা এবং আদিবাসির উপভাষার মধ্যেও বেশ মিল পাওয়া যায় । আমরা দেখেছি যে, তাদের স্থানান্তরগুলো বা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যে যাওয়া তা তুলনামূলকভাবে নির্জন দূরের পাহাড়ে যেখানে সহজে চলাচল করা যায়না এমন স্থানে তারা স্থানান্তরিত হয়েছে যার কারনে সে স্থান অনুযায়ী তাদের জাতিগত আচরনের বৈশিষ্ট্য ও চরিত্রগুলোকে প্রভাবিত করেছে তাদের মানসিক ও চারিত্রিক পরিবর্তনের জন্য এবং ছাপ ফেলেছে বলে ধারনা করা হয় ।

কিন্তু কিছু জাতিগত যে ভাষা সেটা অন্য পাহাড়ের গারোদের মতই মিল রয়েছে ।  এ ভাষা থেকেই পরিচয় বহন করে এবং প্রমান করা যায় যে, তাদের উত্তরাধিকার বা বংশ এবং আদিপুরুষ একই জায়গা থেকেই উৎপন্ন হয়েছিল।
গারোদের বিভিন্ন কল্পকাহিনী, লোকগীতি এবং লোকগান থেকে প্রমান পাওয়া যায় যে, তারা তাউরা নামক স্থান থেকে স্থানান্তর হয়েছে যা তিব্বত এর একটি এলাকা । যখন দেখলো যে তাদের জমি শুষ্ক ও চাষ অনুপোযোগী হয়েছে আর সেখানে ঝুম চাষ করার জন্য অনুকুল পরিবেশ নেই, তখনই তারা সেই জায়গা ত্যাগ করেছে ।
একটি কথন আছে, গারো ভাষায়ঃ
A ba cha na a namjana
Mina dango mi namjana,
Kilgran puo kiljo jana,
Songdongna a song gitalko am na,
Chiringna chiga dingtangko nina
(Finding the land unsuitable for jhum cultivation, and having no water to drink, the area being practically desert land they set out in search of fertile land).



এর বাংলা র্অথ হলোঃ
ফসল ফলানোর জন্য জমি আর উর্বর না হওয়াতে
ধান সবজি ফসল ভাল না হওয়ার জন্য
পানি খাওয়ার জন্য কোন পানি না থাকার কারনে
আরো কোন কিছুই না হওয়ার জন্য
নতুন বসতি স্থাপনের জন্য পানীয় জলের ও উর্বর জমির জন্য আমরা আরেকটি উর্বর জায়গা খোঁজি ।।

প্লেফেয়ার এর উদ্বৃতিতে আরো পাওয়া যায় যে, এক পর্বত থেকে আরেক পর্বতের কাছে যে বসতির স্থানান্তর করা হয়েছে তা হিমালয়ের সাথে সম্পর্কিত । তিব্বত ও গারোদের মধ্যে কোন বন্ধন না থাকলেও আমরা যদি গারো ভাষা এবং তিব্বতের ভাষার সাথে তুলনা করি তাহলে পাই যে তাদের ভাষার মধ্যে কিছু সাদৃস্য, অনুরুপতা এবং মিল রয়েছে । 

তালিকা করে তুলনা করে দেখলে দেখা যায় যে, গারো ও তিব্বত ভাষার অনেক শব্দের মধ্যে অনেক মিল রয়েছে । প্লেফেয়ার তার “The Garoবই এ নীচের শব্দগুলো দেখিয়েছেন যা শব্দের অর্থগুলোও একই।
         শব্দ      -    গারো ভাষা - তিব্বত
১। নদীর তীর - ড্রাম - ড্রাম
২। মৃত্যু        - সিয়া - শিয়া
৩। পাহাড় - হাব্রি - রি
৪। খাওয়া - চাআ - ওয়াহা
৫। মা         - আমা - মাআ  ইত্যাদি ।

"গারো মাতৃভূমি সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রায় প্রত্যেকেই সর্বাধিকবার স্থানের নাম হিসাবে ব্যবহৃত করেছে এই তিব্বত যার কারনে তিব্বতকে একটি উপযুক্ত ও যথাযথ স্থান বলে ধারনা করা হয়  । এছাড়া তিব্বত থেকে মেঘালয়ে এসে বসতি স্থাপন সম্পর্কিত বিভিন্ন ধরনের আরো মতবাদ দেখা যায় । উপযুক্ত স্থান খোঁজে বসতি স্থাপনের জন্য গারো গোষ্ঠী তাদের নিজস্ব মাতৃভূমি থেকে অনত্র স্তনান্তর হয়েছে বলে জানা যায় ।

তাদের বহু সংখ্যক ঐতিহাসিক লেখনীগুলোতে তাদের ঐতিহ্যগত  বিশ্বাস এ ইহা ধারনা করা হয় যে,
তারা উচুঁ পাহাড় পাড়ি দিয়ে এসেছে যা তারা ”চুয়া আব্রি” বলে যার র্অথ উচুঁ পাহাড় । কখন, কোন সময়, তারা নিজেদের মাতৃভূমি ত্যাগ করে অন্যত্র চলে গিয়েছে বা সমতল ভূমিতে স্থানান্তরিত হয়েছে তার কোন সঠিক ইতিহাস কোথাও স্পষ্ট পাওয়া যায়নি বা কোথায় লিখিতভাবে উল্লেখ নেই । প্লেফেয়ার বলেছেন যে, বহু শতক বছর আগেই এই গারো জনগোষ্ঠী স্থানান্তরিত হয়েছে তা নিশ্চিত করেই বলা যায়  এবং কোন কোন ইতিহাসে নাম না জানা কিছু মানুষ যুদ্বে নিহত হওয়ার পর কবরস্থ করা হয়েছিল বলে সনাক্ত করা হয়েছিল বলেও ধারনা হরা হয় । 

উদাহরণস্বরূপ, গোপালপুর জেলায় রাঙামাটি নামে একটি জায়গা ছিল যা তুরা রেঞ্জের নকরেক টিলার পাশে বাঘমেলাপাহার ও গারোমারি নামে যে স্থান ছিল যাকে বর্তমানে বলা হয় গোয়ালপাড়া ও কামরুপ জেলা তার উল্লেখ পাওয়া যায় । এই বিষয়ের লিখিত কোন রুপ নেই শুধুমাত্র মুখে মুখে একজন আরেকজনের কাছ থেকে শুনে শুনে কিভাবে এক পাহাড় থেকে এখানে বা অন্য জায়গা থেকে এখানে বসতি স্থাপন করা হয়েছে তার সবটুকু স্পষ্টভাবে বর্ননা করা কঠিন যা অনেক ঘটনা হয়তো মনেও করতে পারছেনা । Referring the Ralph Fitch Report (1583) (১৫৮৩)  এই প্রতিবেদন অনুযায়ী প্লেফেয়ার বলেছিলেন ২০০ বছর আগের যখন ভুটান, বাংলা এবং তিব্বত এর মধ্যকার যে বিচরনের গল্প বা ইতিহাস তা লিখিত রুপ ছাড়া এভাবে মনে করা কঠিন এবং বিশ^াস করাও অসম্ভব তবে কিছু ক্যাম্প এ সৈন্য প্রবেশ করে অভিবাসনের ঘটনা হয়েছে যার স্থানীয় নাম অনুসারে হয়ে থাকতে পারে বলে ধারনা করা হয় যা গারো এবং ভুটানরা এসময় তিব্বত এ টিকে থাকতে পারেনি বলে একটা ইতিহাস ছিল ।

কিন্তু কিছু অভিজ্ঞ পন্ডিতগন ঐতিহাসিকগন মনে করেন যে, অন্তত ১০০০ থেকে ২০০০ বছর আগের অভিবাসন ঘটনা হয়ে থাকতে পারে । কিছু তিব্বতী বার্মাদের উপস্থিতি ছিল ভারতের সম্মুখভাগে, মেঘালয় পাহাড় ঘেষে দক্ষিণ পাশ ধরে আসামের সাথে এবং ব্রম্মপুত্র বা টিসাংপো হয়ে নেপাল ও গাওরায়াক খোমান ধরে পাড় হয়ে চলে যায় যা পশ্চিম গারো হিলস ও কামরুপ নামে জায়গাটির সন্ধান পাওয়া যায় । গারো আদিবাসীদের নিজেদের মধ্যে একটা বিশ^াস আছে যে, কিরাতাস হলো একটি বন্য অ-আরিয়ান উপজাতি যা ভারতের উত্তপূর্বদিকের পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করতো যা মঙ্গলীয়ভুক্ত ছিল ।

The names of seven Garo ancestors and several chiefs are found in different Garo folk songs and stories. Jappa Jalimpa, Sukapa, Bongipa, Toginpa, Damjenpa, Ejingpa, Kusanpa, Dasingpa, Asanpa, Chupanpa, Kumapa, Rejapa, Kurengpa, nenggilpa, nagonpa, Chondapa, Panongpa, Rekinpa, Dopapa, Gesim, Kalsim, Raji and Do pa was the chief who led the Garo people from Tibet to the plains of Bengal. Himma, Dolma, Bisoma, Sikme, Dome Ullonga and Ullongi were the ancestoral mothers.

গারো লোকাল গান ও গল্প গুলোতে ৭ জন গারো পূর্বপুরুষদের ও কিছু নেতাদের নাম পাওয়া যায় যা, লোকগীতি ও গল্পগুলোতে উল্লেখ রয়েছে । যেমনঃ জাপা জালিমফা, সুকাফা, বনগিপা, থগিনপা, দামজেনপা, ইজিনফা, খুসানপা, দানিসপা, চনদাপা, পাননপা, কুমাপা, রেজাপা. কেিরংপা, নেংগিলপা, নাগংপা, চনদাপা, , পানংপা, রেকিংপা, দপাপা, গিসিম, কালসিম, রাজি ও দপা তারা চীফ ছিল যারা তিব্বত থেকে বাংলা সমতলে নিয়ে আসতে নেতুত্ব দিয়েছিল । হিমমা, দলমা, বিসমা, সিকমি, ডমি, উলংগা ও উলংগি তারা তাদের মা ছিলেন । 

গারোদের আরো একটি  বিশ্বাস ছিল যে, ৪০০ বছর আগে গারোদের একটি বসতি ছিল কুচবিহারে যেখানে গারোদের মৃত্যুর কথাও উল্লেখ রয়েছে । তারা খুব ধনী এবং সম্ভ্রান্ত বংশধর ছিলেন । সুতরাং তারা সুখীও ছিলেন । কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত স্থানীয় লোকেরা তাদের খাদ্যভ্যাস ও সামাজিক পদ্ধতি পছন্দ করতোনা তাই তাদেরকে সেখান থেকে বিতাড়ন করার জন্য চেষ্টা করেছিল । অন্যদিকে সেই জনবসতিতে যে রাজা ছিলেন বা নেতা ছিলেন তার দ্বারা যে খাজনা র্ধায্য করা হয়েছিল সেটাও অমান্য করে গারো গোষ্ঠী সেই খাজনা পরিশোধ করতোনা । এটাও একটা ঝুঁকি ছিল তাদের জন্য ।
এর জন্য বিভিন্ন গোষ্ঠী এবং নিজেদেরই কিছু অংশ গারো জাতিকে বিচ্ছিন্ন করে  তবে কিছু গারো জনগোষ্ঠী সেখানেই থেকে যায় । এরপর কিছু অংশ বর্তমান পশ্চিমে বাংলাদেশের ময়ময়সিংহ অঞ্চলে আগমন করে । তৃতীয় দলটি এবং সবচেয়ে বড় দলটি পূর্বদিকে চলে যায় এবং দুবানী রাজ্যের ধুবরিতে পোঁছায় । ধুবানি রাজ্যের রাজা তাদেরকে বন্ধুত্বসুলভ মনোভাব নিয়ে গ্রহন করে কিন্তু স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য তাদেরকে অনুমতি দেয়া হয়নি । তাই গারোরা আবার অন্য জায়গায় বিচরন করে,  তারা ব্রম্মপুত্র নদের উত্তর তীরে বিচরন করে এবং শেষ পর্যন্ত ব্রম্মপুত্র ও মানাস নদীর সংযোগ স্থলে পৌঁছায় । গারোরা এ জায়গাকে  বলে “রাজা ধুম পাটালো, ররী ওহম ভাঙালো ।’’

সেখানে তাঁরা ভুটিয়ার সাথে সাক্ষাৎ হয়, যাকে তারা "লংগী লংগা" বলে। এই নতুন জায়গায় তারা একটি অদ্ভুত সমস্যার সম্মুখীন হয়। সেই জায়গার রাজা (জুজু-সিলস) একটি গারো মেয়ের রুপ লাবন্য দ্বারা আকৃষ্ট হয়েছিল। তিনি তার বাহিনী দ্বারা তাকে দূরে ছিনিয়ে নিতে সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। রাজার কাছ থেকে মেয়েকে রক্ষা করার জন্য, গারোরা তাকে রক গুহায় রেখেছিল . গারোরা এই জায়গাকে 'যোগীগোপা' নাম দিয়েছিল। যোগী মেয়েটির নাম ও গোপা মানে লুকিয়ে রাখা। এভাবে, যোগীগোপাকে গারোদের জায়গা বলে মনে করা হয় যেখানে যোগী লুকিয়ে ছিল।

অতএব, সেই মেয়টির নাম অনুসারে যোগীগোপা জায়গার নামটি হয়েছে ধারনা করা হয়,  যোগীগোপা এর নামে আরেকটি ব্যাখ্যা আছে। এটিও বলা হয় যে, যোগীগোপা একটি নদীর তীরের কাছাকাছি পাথরের পাহাড়ে কাটা কিছু গুহা থেকে যার নাম যোগীগোপা আবিষ্কৃত হয় যা একসময়ে যোগী/সাধক দ্বারা ব্যবহৃত  হতো বলা হয় ।

অবশেষে তাদেরকে যোগীগোপাও ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল । তারা ব্রম্মপুত্র নদী অতিক্রম করেছিল যা তারা আমা ওয়ারী (মাদার নদী) বলে তাদের কাছে এই আমাওয়ারী নামক নদীকেই সবচেয়ে বেশী বড় নদী বলে মনে করতেন, যেখানে তারা গাছপালা রোপন ও চাষবাস করেছিল তাদের স্থানান্তরের সময়ে । ব্রম্মপুত্র নদী পার হয়ে তারা নদীর দক্ষিন তীরে গারোমারীতে পৌঁছে গেলো একসময় । এই গারোমারীতেও তারা শান্তিপুর্ন ভাবে বসবাস করতে পারলোনা । সেখানকার সেই রাজা তাদেরকে সর্বদা অনুসরন করছিল এবং যখন তারা একসাথে হয়ে দুপুরের আহার করছিলো তখন সেই রাজা তাদের অতর্কিতে আক্রমন করে এবং কয়েকজন গারোপুরুষ সেই আক্রমনে নিহত হয় বলে কথিত আছে ।
তখন থেকেই এই জায়গাটি গারোমারী নামে পরিচিত ছিল । কিছুদিনের জন্য তারা সেখানে থেকে  যুদ্ধ করে শোক দিবস পালন করে এবং পরে সেখান থেকে আবার অনত্র চলে যায় । তারা কামরুপ জেলার কামাক্ষা এলাকাতে পৌঁছে যাকে বর্তমানে নীলাচল বলে । বর্তমানে তারা সেই জায়গাটিকে 'সালজান পাত্রা রাঙদোগাচো' বলে ডাকে । গারোদের লোক গীতির মধ্যে এটি পাওয়া যায় যেখানে এই স্থান সম্পর্কে উল্লেখ পাওয়া যায় । তারা গাইতো ঃ
"আসং কামাক্ষা,
চিখা চিরিংনি,
গ্যানটিনি রিং, রিংডাম আসং,
চিরিংনী জিঞ্জিনরাম চিংআ "।

(কামাক্ষা  একটি জায়গা, যেখানে কখনও কখনও জীবনের গাই গায়তো, প্রচুর জলে ভরপুর থাকতো) সেখানে আসামের রাজা বসবাস করতো, তার নাম লীলাজিং । তারা সেখানে অনেক বছর বসবাস করে । তাদের পাশের একজন রাজা একজন গারো সুন্দরী যুবতী নারীকে ভালবাসতে চাইলো এবং প্রেম নিবেদন করতে চায়লো । রাজা সেই সুন্দরী গারো মেয়েটিকে বিবাহ করে এবং তার আত্বীয় স্বজনকে সেই রাজ্যে থাকতে অনুমতি প্রদান করে । কিন্তু  কিছুদিন পর আসামের রাজা তাদের নির্যাতন ও অত্যাচার করতে শুরু করে। তাই আবার তারা বাঘমেলাপাহাড় নামক স্থানে চলে যায় যাকে গারো ভাষায় মাচ্ছামেলারাম বলে। আসাম এর কামরুপ জেলা হতে পূর্বে বোকো এলাকার ৮কিলো মিটার দূরে একটি পাহাড়ে অবস্থিত এই জায়গাটি ।

এই জায়গাটিতে যাদের মাচ্ছামারো বলা হতো তাদের এখানে বিস্তৃতি হতে থাকে । মাচ্ছামারো গারোদের জন্য হুমকিস্বরুপ ছিল । তাই গারো গোষ্ঠী আবার নিরাপদ জায়গা খোঁজতে থাকে ফসল ফলানোর জন্য এবং বসতি স্থাপনের জন্য । লীলাজিং রাজ্য ও আরামবিট সম্পর্কে প্লেফেয়ার বলেন, আসামের রাজবংশের তালিকাটিতে কোনটিতেই লীলাজিং বা আরামবিট নামে কোন কিছুর উল্লেখ নেই । বাঘমেলাপাহাড় থেকে গারো গোষ্ঠী আরো পশ্চিমদিকে সরে যায় এবং “সাংকাটি ওয়াকমেটন মাটিয়া পোছিয়” নামক স্থানে চলে যায় আবার । যা গৌহাতি এলাকার গোয়ালপাড়া রোডের ৫/৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত । তারপর পরে এ জায়গার নাম হয় সানকাটি । বর্তমানে এখানে রাব্বাস গোষ্ঠী বসবাস করে এবং কিছু অন্য গোষ্ঠীর লোকও বসবাস করে ।
গারোদের মধ্যে আরেকটি  বিশ্বাস আছে যে, তাদের পূর্বপুরুষেরা এখানে ১২৯ বছর ধরে বসবাস করেছিল । তারপর তারা আরো একটি বিষয়  বিশ্বাস করে যে, তাদের পূর্বপুরুষেরা এখানেই প্রথম একটি বাজার স্থাপন করে । তারা একটি বড় সভা করে যেখানে মাতৃসুত্রীয় প্রথার প্রচলন করেছে যা এখনো গারোদের মধ্যে বিদ্যমান আছে ।

এ জায়গা থেকে গারো জাতি আবার আরো পশ্চিমদিকে সরে যায় যা বাস্তবিক তাদেরকে পশ্চাদদিকে ধাবিত করে । যা ছিল তাদের পিছন দিকে ফিরা, পশ্চাদপদতা এবং এভাবেই এ গারো গোষ্ঠী বিভিন্নভাবে ভেঙে যায় এবং ছিন্ন বিচ্ছিন্নভাবে বিভক্ত হয়ে পরে । এখান থেকেই নিজেদের মধ্যে বিভক্তির সুত্রপাত হয় । 

গারোদের একটি বড় অংশ আসামের গোয়ালপাড়া জেলার পশ্চিম কৃষানী থেকে তিন মাইল অদূরে টুকেশ^র নামক স্থানে যেতে যেতে পৌঁছে যায় । তারা টুকেশ্বরে  ধনী ও সমৃদ্ধশালী হয়ে যায় । গারোদের সাধারণ বিশ্বাস অনুসারে, একজন গারো রাজার রাজ্য স্থাপন হয়েছিল সেখানে । রাজা আব্রাসন বা হাব্রা উসিংপা(King Abrasen or Habra Usingpa তারা সেখানকার প্রথম গারো রাজা বলে কথিত আছে । রাজা আব্রাসন বর্তমান গোয়ালপাড়া জেলার অধীনে হাব্রাগাত পরগনাতে  সামবল আদিং নামে রাজ্য স্থাপন করেন । এই সময়ে দিসেনসন প্রাং নামের কিছু গোষ্ঠী গারোদের উপর আক্রমন করে তাই কিছু গারো সেখান থেকে সরে যাওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত হয় ও সরে যায় এবং আবার তারা গারো পাহাড়ে প্রবেশ করে ।

একটা অংশ আবং নগার অধীনে এবং তার স্ত্রী সিলমি দুহার সাথে তুরা পাহাড়ের সর্বোচ্চ চুড়ায় নকরেক টিলায় বসতি স্থাপন করে । সেখান থেকেই গারো পাহাড়ের বিভিন্ন এলাকাতে তারা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পরে । তখন থেকেই এই তুরা এলাকা গারোদের স্থায়ী বসতি ও শক্তিশালী একটি অঞ্চল হিসাবে পরিগণিত হয়ে আসছে । যারা এই দলের সাথে আসেনি তারাই বাংলাদেশ, বঙ্গদেশ এবং আসামের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পরে ও বসতি স্থাপন করে ।

সুতরাং এটি উপরের আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে অনেকদিন ধরে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার নিচে তারা স্থানান্তরিত হয়ে অভিবাসনের সময়গুলোতে বিভিন্ন দূর্গম পথ পাড়ি দিয়েই গারো অধিবাসীরা বসতি স্থাপন করেছে । তারা নদীর নাম “আমাওয়ারী” মানে মা-নদী নামে ডাকতে শুরু করে । সেখান থেকেই তারপর গারো আদিবাসী ব্রম্মপুত্র উপতক্যা থেকে  তার সংলঘ্ন এলাকায় ও অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসতি স্থাপন করে যা বর্তমানে গারো পাহাড় নামে পরিচিত ।
প্রকৃতিগত ভাবেই অনুমান করতে পারি যে, তারা গারো জনগোষ্ঠী বংশগতভাবে বা গোষ্ঠীগতভাবেই এক স্থান হতে অন্য স্থানে স্থানান্তরিত হয়েছে ও অস্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেছে, তারা এক ধরনের যাযাবর জাতি ছিল । এই গবেষনায় দেখা গেছে যে, প্রায় সব গারোদের বসতিই বা গ্রামে, দুর্গম এলাকাতে । মাত্র একটি বা দুটি গোষ্ঠী/বংশ পরিলক্ষিত হয়েছে সম্মূখ বা সামনের অংশে ।  রবিন বার্লিন লিখেছেন যে,  “ গারো জনগন খুব দ্রুত গতিতে অভিবাসিত হয়েছে । তারা প্রতিবারই নীচে উপরে- সামনে পিছনে এভাবে স্থানান্তরিত হয়েছে কিন্তু খুব অল্পসংখক জনগন সুসংগঠিতভাবে অভিবাসিত হয়েছে র্দীঘকাল ধরে ও স্থায়ীভাবে যা তাদের ভাষাগত ও প্রথাগত বৈশিষ্ট্য ধরে রাখতে সম্ভব হয়েছে । তাদের মধ্যে আরেকটি চিত্র দেখা যায় যে, যারা প্রায় সর্বদা অভিবাসিত বা স্থান্তরিত হয়েছে এদিক ওদিক নিজের সবকিছু ছেড়ে দিয়ে তারা নিজেদের ঘরেই আবার ফিরে আসে এবং তারা নতুন জায়গায় সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা হিসাবে স্থায়ীভাবে বসতি গড়ে তুলেনা তারা, যখন দেখতে পায় যে নতুন জায়গাটি পুরোনো জায়গা থেকে স্বতন্ত্র, আলাদা তখন স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য অবকাঠামো তৈরী করা শুরু করে ।

তারা যেখানে যে ভুখন্ডের আশপাশে বা যার চারপাশে কোন রাজার রাজত্ব নেই এমন স্থানই প্রত্যাশা করতো ও বেছে নিতো । প্রস্তর যুগ থেকেই দক্ষিণ ও দক্ষিন-পশ্চিম  এশিয়া অঞ্চলে তাদের বিচরণ ও বসতি ছিল বলে ধারনা করা হয় ।
(Changing status of women in Matrilineal Garo society- Shri Anjan Jayoti Borah-August 2010) এই বই হতে অনুবাদিত ।
চলবে-------------

মন্তব্যসমূহ

আলোছায়া কথামালা

গারোদের উৎপত্তি, সমাজ ব্যবস্থা, কৃষ্টি-সংস্কৃতি, বিবাহ প্রথা ও মাতৃসূত্রীয় প্রথা

গারো শব্দের উৎপত্তি ও বিভিন্ন মতবাদ (গারোদের উৎপত্তি, সমাজ ব্যবস্থা, কৃষ্টি-সংস্কৃতি, বিবাহ প্রথা ও মাতৃসূত্রীয় প্রথা -১ম পর্ব)